শ্রী শ্রী নারায়ণ ঠাকুর

ভাটপাড়ার (ভট্টপল্লীর) প্রতিষ্ঠাতা আদি সিদ্ধমহাপুরুষ বাশিষ্ঠ নারায়ণঠাকুরের কিছু পরিচয় প্রদান ও তাঁহার বংশধরদিগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

কর্ম্মব্রহ্মপথপ্রচারসবিতা সিদ্ধেঃ পরং পারগো
ব্রহ্মর্ষেঃ কুলমাজগাম জনুষা যশ্চাদিরেষাং পুমান্
যন্নামস্মরণং ভবার্ত্তিশমনং কালে সুঘোরে কলৌ
তং বন্দে শতশো হিতায় জনুষো নারায়ণং বা পরম্ ॥

ভাটপাড়া কতদিনের গ্রাম সে বিষয়ে প্রমাণ মিলিতেছে না, তবে এই গ্রাম যে শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূর পূর্ব্বসময়ে খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ বাঙ্গালা ৯০০ সালে ছিল, তাহার একটী নিদর্শন মিলিয়াছে। মাহেশের প্রসিদ্ধ রাধাবল্লভজীউ বিগ্রহের স্থাপয়িতা ৺কমলাকান্ত (কমলাকর) পিপলাই মহাশয় শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের অব্যবহতিপরবর্ত্তী কারণ ১৪৫৫ শাকে শ্রীশ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর পুরুষোত্তমে লীন হওয়ার পর, ১৫ পোনর বর্ষ মধ্যে শ্রীভগবানের দারুমূর্ত্তির পরিবর্ত্তন হয়, ঐ সময় পুরুষোত্তমে অবস্থিত পিপলাইমহাশয় স্বপ্নাদেশ পাইয়া ঐ ত্যক্ত দারুমূর্ত্তিটীকে প্রথমে মাহেশে আনয়ন করেন এবং ঐ দারু হইতে শিল্পীসাহায্যে বিগ্রহের অবতারণা করিয়া প্রতিষ্ঠা করেন, ইহা বহুপ্রমাণে সিদ্ধান্ত আছে। পিপলাই মহাশয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র বিপ্রদাসপিপলাই (যাঁহার পূর্ব্ব নিবাস ছিল বাদুড়দিয়া গ্রামে) ১৪১৭ শাকে অর্থাৎ এখন হইতে কিছু অধিক চারিশত বৎসর আগে মনসার ভাসান গীতিকাব্য রচনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার গ্রন্থে বর্দ্ধমান কলন হইতে আরম্ভ করিয়া বেহুলার গমনকালীন রচনায় ভাগীরথীর উভয়পার্শ্বের অনেকগুলি গ্রামের বর্ণনাক্ষেত্রে পূর্ব্বপারে কাঁকনাড়া ভাটপাড়া মূলাজোড় প্রভৃতির নাম উল্লেখ আছে। এই প্রমাণেই চব্বিশ পরগনার গেজেটপ্রণেতা মাননীয় হান্টার সাহেব ঐ বিপ্রদাস কবিকে আকবর বাদশাহের পূর্ব্বের ও ভাটপাড়াগ্রামকে চারিশত বর্ষের পূর্ব্ববর্ত্তী বলিয়া স্থির করিয়াছেন। সুতরাং প্রতাপাদিত্যের রাজ্যস্থাপনের বহু পূর্ব্বে এই গ্রন্থ রচিত, এই গ্রন্থে ভাটপাড়া নামের স্পষ্ট উল্লেখ থাকায় ইহাই স্থির হয় যে খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতেও এই নামেই এই গ্রাম বিদ্যমান ছিল! এখন ৺নারায়ণ ঠাকুরের চরণস্পর্শে কোন সময় এই গ্রাম পবিত্র হইল তাহার সন্ধান লইতে হইলে অগ্রে জানা আবশ্যক নারায়ণঠাকুর কোন বংশের কাহার পুত্র, কোথা থেকেই বা কি অভিপ্রায়ে এখানে আসিলেন। এই সকল বিষয়ের সম্যক্ তথ্য নির্দ্ধারণ করিবার পক্ষে সাহায্য পাইবার কোন প্রকার ইতিহাস নাই। কেবল পূর্ব্বাপরবর্ত্তীদের হস্তলিখিত পুস্তকাদিতে স্বাক্ষর ও লিখিতসময় ও পুরুষসংখ্যা অনুসারে শতাব্দনিরুপণ এবং অধস্তন বংশধরদিগের প্রতিষ্ঠিত নবরত্নাদিতে খোদিত লিপি ও পুরুষপরম্পরায় প্রচলিত প্রবাদের উপর নির্ভর করায়ই তাঁহার সময়নিরূপণে যত্ন লইয়াছি। নারায়ণঠাকুরের পিতামহ শুক্লযজুর্বেদী মাধ্যন্দিনশাখী ত্রিপ্রবর বসিষ্ঠগোত্র মহাত্মা গদাধর ঠাকুর কান্যকুব্জ হইতে এই দেশে আসেন। কান্যকুব্জ বা কনৌজরাজ্য মুসলমান অধিকারে আসায় দস্যুদিগের দ্বারা নির্যাতনভয়ে যেই শতাব্দীতে গদাধরের ন্যায় অনেক বেদজ্ঞ অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ এদেশে আসেন, তাঁহারাই নবাগত পাশ্চাত্য বৈদিক নামে কুলপঞ্জিকায় অভিহিত আছেন। গদাধরের পিতার নাম কপিল ও পিতামহের নাম মহাবীর, এখনও বংশধরেরা ঐ নামে তর্পণ করিয়া থাকেন। গদাধরের কনৌজ হইতে আগমনের প্রমাণরূপে নিম্মলিখিত শ্লোকটী তদীয় বংশধরদিগের মুখে প্রবাদরূপে এবং ১৭০ বৎসর পূর্ব্বে বগড়ী শ্যামপুরনিবাসী গদাধরেরই অন্যধারাসম্ভূত বাসিষ্ঠ বৃন্দাবনগোস্বামী\footnote{বৃন্দীবনগোস্বামীই বৃন্দাবনচন্দ্র নামে যে কৃষ্ণবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন তাহা এখনও শ্যামপূরে সেবিত হইতেছেন।} মহাশয়ের স্বহস্তলিখিত ‘গোপালতাপনী’ গ্রন্থে ও ১৪৫ বর্ষ পূর্ব্বে গদাধরের অধস্তন সপ্তমপুরুষ ভাটপাড়ানিবাসী রামকান্ত সার্ব্বভৌম মহাশয়ের স্বরচিত ‘রামলীলোদয়’ মহাকাব্যের পরিশেষে নিজ বংশের পরিচয়ক্ষেত্রে লিখিত আছে দেখা যায়।
দস্যুভয়াণ্ত্রাতুমনা ধর্ম্মদারসুতাদিকান্‌।
কান্যকুব্জাৎ সমায়াতো গদাধরমহাসুধীঃ।
গদাধরনস্য দ্বৌ পুত্রৌ খ্যাতৌ বিষ্ণু-জনার্দ্দনৌ॥
এখানে জানাইয়া রাখি যে ভাটপাড়ার বাসিষ্ঠ গুরুঠাকুরেরা গদাধরের ২য় (দ্বিতীয়) পুত্রের বংশধর। উপস্থিত প্রসঙ্গসঙ্গতিবশে ১ম পুত্র বিষ্ণুর বিষয় কিছু বলা প্রয়োজন হইল, গদাধর কনৌজ হইতে বঙ্গে পৌছিলেন, সহযাত্রিকদের অভিপ্রায়মতে পুরুষোত্তমদর্শনে অভিমুখ হইলেন, ঐ সময়ের ১৫/২০ বৎসর পূর্ব্বে কনৌজ হইতে সমাগত ঋগ্বেদী মৌদ্গল্য মুরারিভট্ট, ভরদ্বাজ উপেন্দ্রভট্ট ও গৌতম গণপতিভট্ট মহাশয় প্রভৃতিরা তখন বগড়ীতে বাস করিতেছিলেন, ঐ পথে পুরুষোত্তমাভিমুখে যাইবার কালে তাঁহাদের আতিথ্য গ্রহণ করেন। পথশ্রান্তা গুব্বিণী বনিতা ও কিশোরবয়া পুত্র বিষ্ণুকে তাঁহাদের অগ্রাহাতিশয়ে তাঁহাদেরই তত্বাবধানে রাখিয়া পুরুষোত্তমযাত্রা করেন। এই বগড়ীতেই তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র জনার্দ্দন ভূমিষ্ট হন। ঐ সময় বরদারাজা শোভাসিংহ সেই অপ্রাপ্তবয় বিষ্ণুর এক অলৌকিক ব্রহ্মশক্তি\footnote{মন্ত্রপুত সলিলনিক্ষেপে মত্তহস্তিত বশ্য হয়।} দেখিয়া বিস্মিত হন ও ঋষিজ্ঞানে তাঁহার নিকট হইতে দীক্ষা লন। শ্যামপুরবাসী গোস্বামিমহাশয়েরা সেই বিষ্ণুরই বংশধর এবিষয় বিশদভাবে আমার স্বরচিত সংস্কৃত বংশপরিচয় গ্রন্থে বিবৃত আছে। পুর্ব্বোক্ত গণপতিভট্ট — বাঙ্গালার, প্রথম স্মৃতিসংগ্রহকার বৈষ্ণবচূড়ামণি গোবিন্দানন্দ কবিকঙ্কণাচার্য্যের পিতা এই গণপতিভট্ট, জ্যোতিষ্মতীনাম এক জ্যোতিষের টিকা প্রস্তুত করিয়া তাহার শেষে লিখিয়াছেন:
বিশ্বাঙ্গশ্রুতিসম্মিতে কলিযুগস্যাব্দে প্রসিদ্ধাহ্বয়ো
ভট্টঃখ্যাতগুণোত্তরো গণপতির্জ্যোতির্বিদামগ্রণী।
লক্ষ্মীনন্দিপুরন্দরানুজ পদদ্বন্দ্বারবিন্দার্পিত
স্বান্তঃ সন্ততমিন্দিরাপরি তো জ্যোতিষ্মতীমাতনোৎ ॥
ইহাতে প্রমাণ হইতেছে যে কলিযুগের ৪৬১৩ এই অব্দে অর্থাৎ এখন হইতে ৪৩৩ বর্ষ পূর্ব্বে ঐ পুস্তক লিখেন, ইহা তাঁহার প্রাচীন বয়সের লেখা কারণ তাঁহার পুত্র গোবিন্দানন্দের নিবন্ধরচনা ১৫৪০ খৃঃ অর্থাৎ এখন হইতে ৩৮৫ (তিন শত পঁচাশি) বৎসর পূর্ব্বে ইহা প্রত্নতাত্ত্বিকদের সিদ্ধান্তিত, বরোদা রাজা শোভাসিংহের সঙ্গে পাঠানদের যুদ্ধঘটনা ১৫১২ খৃঃ, এখন হইতে ৪১৩ বর্ষ পূর্ব্বে। ইহাতে বুঝা যায় গণপতিভট্ট প্রায় সাড়ে চারি শত (৪৫০) বৎসরেরও পূর্ব্বে বঙ্গে আসেন। গণপতিভট্ট গ্রন্থ প্রস্তুত করিলেন ৪৩৩ বৎসর পূর্ব্বে, তাঁহার পুত্র গোবিন্দানন্দের নিবন্ধ প্রস্তুত হইল ৩৮৫ বৎসর পূর্ব্বে, রাজা শোভাসিংহ পাঠানদের সঙ্গে সংযর্ষ ৪১৩ বৎসর পূর্ব্বে। ঐ রাজা শোভাসিংহ গদাধরপুত্র বিষ্ণুকে আশ্রয় করিলেন ও গদাধর পূর্ব্বাগত গণপতিভট্টদিগের সহযোগে স্ত্রী-পুত্র রাখিয়া তীর্থযাত্রা করিলেন। ইঁহার কোন অসামঞ্জস্য হইল না। এদিক দিয়াও বলা যায় যে গদাধর ৪৪০ বৎসরেরও পূর্ব্বে বঙ্গে অসিয়াছিলেন অর্থাৎ বর্ত্তমাণে গদাধর হইতে ১২/১৩, কোথায় ও বা ১৪ বা ১৫ পুরুষ হইতে দেখা যাওয়ায় এখন হইতে একশত বৎসর পূর্ব্বের পুরুষদের তিন পুরুষে একশত ও পরবর্তী শতাব্দটী চারি বা পাঁচ পুরুষে ধরিলেও গদাধর ঠাকুর কিঞ্চিনন্যনাধিক ৪৫০ (সাড়ে চারিশত বর্ষের) লোক হন, সুতরাং এই প্রবাদ শ্লোকটি এখান অনুকূলে উল্লেখযোগ্য হইল –

সার্দ্ধাচ্চতুঃশতাদর্ব্বাক্ বর্ষাত্ পূর্ব্বং চতুঃশতাত্।
গদাধরঃ সমায়াতঃ পদ্ভ্যাং বঙ্গেষু বান্ধবৈঃ ॥
গদাধর তীর্থ প্রত্যাগমনোত্তর কিছুকাল বগড়ীতেই থাকেন। তখন ক্রমাগত ঐ পথে পাঠানদের গতিবিধি হইতে থাকায় ঐ সকল স্থানে নির্ব্বাধে ব্রহ্মনিষ্ঠার সুযোগ না পাইয়া এবং নিকটেই বরদারাজার সম্পর্কে বিষ্ণুর অবস্থান নিজের প্রীতিকর না হওয়ায় ঐ স্থান ও বিষ্ণুর সহযোগ পর্য্যন্ত ছাড়িয়া যশোরে ধূলিপুর-সমাজের ধলবেড়ে গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হন, তখন তথায় নবাগত অনেক বেদজ্ঞ বাস করিতেছিলেন, একটী বৈদিকসমাজও গঠিত হইয়াছিল এবং তখন যশোরে হিন্দুশাসক ভূঞাদের অধিকারে বর্ণাশ্রমধর্ম্ম অব্যাহত ছিল এবং যাশোরসম্বন্ধে এই প্রবাদ চলিতেছিল –‌
যশোহরপুরী কাশী দীর্ঘিকা মণিকর্ণিকা।
তাহার কারণ পীঠমালাতে যশোরে পাণিপদ্ম পতিত হওয়ায় যশোহর পীঠস্থান ছিল ও আছে। গদাধরের তিরোধানের পর তাঁহার পুত্র জনার্দ্দন ঠাকুর ধূলিপুরেই প্রতিষ্ঠার সহিত বাস করেন, তাঁহার সময়ে নকীপুরের চৌধুরীদের সঙ্গে গৌরবাস্পদ গুরুতা-সম্বন্ধ সংঘটিত হয়। কেহ কেহ বলেন যে কোটালিপাড়ার গোষ্ঠীপতি হরিহর চক্রবর্তীর অনুষ্ঠিত অগ্নিযজ্ঞে বঙ্গের চতুর্দ্দশ বৈদিকসমাজ আহূত হন, জানা গিয়েছে যে নানা প্রাচীন ও নবাগত বৈদিকের সমাজ হইতে সামবেদিবসিষ্ঠ ও প্রবরভেদে দ্বিবিধ যজুর্বেদিবসিষ্ঠ সন্তানেরাও তথায় উপস্থিত ছিলেন, তখন ধূলিপুরে ধলবেড়েও একটী বৈদিকসমাজ ছিল এবং ঐ স্থানে জনার্দ্দন ঠাকুর ব্যতীত আর কেহ যজুর্বেদী বসিষ্ঠ ছিলেন না, সুতরাং ইহাতে বুঝা যায় যে জনার্দ্দন ঠাকুরও উক্ত যজ্ঞসভায় যোগদান করিয়াছিলেন। কিন্তু আমি এমতের সম্যক্ সমর্থন করি না – কারণ যশোরেশ্বর প্রতাপাদিত্যের অভ্যুদয়কাল খুষ্টীয় ষোড়শতাব্দীর শেষভাগ ও প্রতাপাদিত্যের অবসানের বিংশতিবর্ষ পরে ঐ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, ইহা প্রমাণিত আছে অতএব তখন জনার্দ্দন ঠাকুরের বয়স ১২০ বৎসরের কম হয় না, তাঁহার অত দীর্ঘজীবী হওয়ার কথা শুনা নাই আর তাহা হইলেও ঐরূপ বয়সে তথায় যাওয়া সম্ভবপর হয় না, এ বিধায় জনার্দ্দনের পুত্র বর্ত্তমান বর্ণনীয় মহাপুরুষ নারায়ণ ঠাকুরেরই তথায় উপস্থিতি সম্ভব এবং সেই বিষয়ে আংশিক প্রমাণও মিলে।
ঐ যজ্ঞে পাশ্চাত্য বৈদিকগণের কুলনিয়ম রক্ষাকল্পে যে কৌলীন্যসূচক অঙ্গ নির্ণীত হইয়াছিল তাহাতে —

বেদো বিত্তং সদাচারো ভূমি-বহ্নি-পরিগ্রহঃ।
ধর্ম্মঃ সত্যং তপশ্চৈবমষ্টাঙ্গং কুলমুচ্যতে ॥
এই পাশ্চাত্যপঞ্জিকায় লক্ষ্মীকান্তমিশ্র মহাশয়ের লিখিত বচনানুসারে নারায়ণ ঠাকুরের বংশধরদিগের নানাসমাজে কুলমর্য্যাদার প্রভূত প্রশংসা আছে এবং ঐ সভাতেই নারায়ণঠাকুরের সম্যক্ পরিচয় পাইয়া শুনকেরা সন্তুষ্ট হন এবং পরে নারায়ণ ঠাকুরের বংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বদ্ধ সংস্থাপিত করেন। নারায়ণঠাকুরের পত্নীর নাম লক্ষ্মী দেবী ছিল বলিয়া শুনা যায়। জনার্দ্দনঠাকুর সাধনার পথে অগ্রসর হইয়াছিলেন, তাঁহার প্রণীত দুর্গার্চ্চাকৌমুদী অতি সারবান্‌ গ্রন্থ, আজিও তদনুসারেই এই ভাটপাড়ায় তাঁহার বংশধরেরা দুর্গোৎসব করিয়া থাকেন। সেই জনার্দ্দনের ঔরসে অবতারভূত নারায়ণঠাকুরের জন্ম হয়। নারায়ণঠাকুরের আবির্ভাবকালের বিশেষ কোন নিদর্শন নাই তবে কাঠালপাড়ানিবাসী তাঁহারই বংশধর শ্রীযুক্ত রামপ্রসন্নবিদ্যারত্ন ঠাকুর মহাশয়ের বাটী হইতে একখানি মহেশ্বরন্যায়ালঙ্কারকৃত কাব্যপ্রকাশের টীকা মিলিয়াছে, তাহাতে নারায়ণ শর্ম্মার স্বহস্ত লিখিত বলিয়া নির্দ্দেশ আছে, ঐ লেখা নারায়ণঠাকুরের প্রাচীন বয়সের লিখা ধরিলে কতক সামঞ্জস্য হয়, যেহেতু তাঁহার পুত্র রামনাথঠাকুরের স্বহস্তলিখিত চণ্ডীপুস্তক ১৫৭৫ শাকের লিখা আমার গৃহে ছিল এবং তাঁহারই লিখিত অমরকোষ ১৫৯৩ শকাব্দায় লেখা বলিয়া সঙ্কেতযুক্ত ভাটপাড়ানিবাসী তাঁহারই বংশধর ৺মহামহোপাধ্যায় শিবচন্দ্র সার্ব্বভৌম মহাশয়ের গৃহে আছে। যদিও ইহাতে পিতা পুত্রের প্রায়ই এক সময়ে লিখন আসে তাহাতেও দোষ কিছু না দেখিলেও কাব্যপ্রকাশের টীকার শেষে "স্বার্থং লিখিতং” এই কথাটী লেখা থাকায় প্রাচীনবয়সে এই লেখার পক্ষে তর্ক উঠে, এক্ষণে সাধারণে বিচার করিবেন।
প্রথম— নারায়ণঠাকুরের স্বহস্তলিখিত কাব্যপ্রকাশ টিকায় ১৫৮৫ শাক।
দ্বিতীয়—নারায়ণঠাকুরের কোটালীপাড়ায় অগ্নিযজ্ঞে গমন ১৫২৫ শাক।
তৃতীয়—তাঁহার পুত্র রামনাথ ঠাকুরের হস্তলিখিত চণ্ডীর সময় ১৫৯০ শাক।
চতুর্থ—ঐ রামনাথ ঠাকুরের হস্তলিখিত অমরকোষের সময় ১৫৯৩ শাক।
পঞ্চম—রামনাথঠাকুরের পৌত্র বীরেশ্বর ন্যায়ালঙ্কারের নবতিবর্ষবয়সে তীরস্থ হওনের সময় বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলা কলিকাতা অবরোধ করিয়া পরপারে চুঁচুড়ায় আসিয়া নৌযানে রাত্রিযাপন করেন ১৭৫৭ খৃঃ—১৬৭৮ শাক অর্থাৎ নারায়ণঠাকুরের সময় হইতে চারি পুরুষে একশত বর্ষ হইল।
ষষ্ঠ—পরবর্তী পুরুষদিগের নবরত্নাদি খোদিত দলীলাদিতে লিখিত সময় দর্শনে ও ২৫ (পঁচিশ) থেকে ৩০ (ত্রিশ) বৎসর হিসাবে প্রতিপুরুষ ধরিলে ইহাই সিদ্ধান্ত হয় যে ৩৫০ (সাড়ে তিন শত) বৎসর হইল নারায়ণঠাকুর আবির্ভূত হন। নিম্নোক্ত শ্লোকটীও এই সিন্ধান্তেরই পরিপোষক—
শতার্চ্চ শাকাত্তিথিমাদথোর্দ্ধং ত্রিংশৎসমান্তঃ কৃচিদেকবর্ষে ।
রবৌ তপঃসপ্ততিথৌ সিতীয়াং সুতো বভূবাস্য হিতায় পুংসাং ॥

অদ্যকার তিথিটীকে সেই প্রাতঃস্মরণীয় প্রভুর আবির্ভাব স্মৃতিদিন রূপে ব্যবহার করিবার পক্ষে কোন ভক্তের প্রতি অলৌকিক স্বপ্নাদেশও কারণ আছে তাহা সময়ে বিবৃত হইবে।
নারায়ণঠাকুরের গৌরবরশ্মি সমগ্রবঙ্গে কি প্রকার বিস্ফুরিত হইয়াছিল তাহার একটী নিদর্শন দেখাইতেছি— খৃঃ—অষ্টাদশশতাব্দীর প্রারম্ভে রচিত নবাগত পাশ্চাত্য কুলপঞ্জিকায় গ্রন্থকার লক্ষণবাচস্পতি মহাশয় নবাগত পাশ্চাত্য বৈদিকগণের পরিচয়ক্ষেত্রে সোপাধিক নারারণ ঠাকুরের প্রকৃষ্টভাবে উল্লেখ করিয়া তাঁহাকে সাধারণের মধ্যে উত্তম বলিয়া গিয়াছেন—
দ্বিজো ভরদ্বাজকুলাব্জসূর্য্যঃ শ্রীমান্‌ হি দামোদরমিশ্রনামা । বসিষ্ঠজোহভীষ্টবিশিষ্টনিষ্ঠো নরেষু নারায়ণঠাকুরাখ্যঃ ॥
পিতৃপথানুসরণ করিয়া নারায়ণঠাকুর বাসগৃহের প্রাঙ্গণে বিল্ববৃক্ষের মূলে সাধনা আরম্ভ করেন, এই সাধনাই তাঁহার সিদ্ধির মূল। সেই প্রাচীন বৃক্ষ দেবাত্মভাবে অধিষ্ঠিত থাকায় বহুদিনই ছিল ! উহা নষ্ট হইলে উহার মূল থেকে যে দ্বিতীয় বৃক্ষ উৎপন্ন হইয়াছে তাহার মূলদেশে নারায়ণঠাকুরের সাধনাবেদীর ভগ্নাবশিষ্ট অংশ এখনও আছে এবং সেই বেদীসংলগ্ন বিল্ববৃক্ষের মূলে বহুদূর থেকে গৃহস্থেরা আসিয়া গাভীর প্রথম দুগ্ধ ঢালে চতুরবর্ণসাধারণে মানসিক করে এবং অভীষ্টরোগনাশ বা পুত্রাদিলাভকামনায় ৺তারকেশ্বর প্রভৃতি অনাদিস্থানের মত হত্যা দেয় এবং সফলকাম হইয়া তথায় সমারোহে দেবীর পূজা দেয়। এবং সেই মহাপুরুষের বাস্তুভিটা বর্ত্তমানে তিনচারি বিঘা জঙ্গলময় হইয়াছে, তথাকার লোকেরা এখনও ঐ ভিটাকে বেলবাড়ী বলিয়াই নির্দ্দেশ করে এবং তাঁহার তথাকার নিষ্কর অন্য সম্পত্তি সকল এই ভাটপাড়ার তাঁহার বংশধরেরা গ্রহণ করেন নাই, শুনিয়াছি চন্দ্রশেখর ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রবংশীয় এড়েদাবাসী বশিষ্ঠগোত্র ঠাকুরেরা ভোগ করিয়া আসিতেছেন, বর্ত্তমানে তাঁহাদেরও অনেক অংশ হওয়ায় অনেকে বিক্রয়ও করিতেছেন। শুনিয়াছি নারায়ণঠাকুর পঞ্চোপাসক ছিলেন এবং ঐ পঞ্চোপাসনার মন্ত্র তাঁহার বংশে একটী ধারায় চলিয়া আসিয়াছে তবে বর্ত্তমানে এখনও সেরূপ দীক্ষা হইতেছে কি না জানি না।
নারায়ণঠাকুর মূলমন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেন এবং তাঁহার যোগসহযোগে মন্ত্রসাধনার প্রভাবে গুটিকাসিদ্ধি প্রভৃতি দুই একটী যোগিজনোচিত ব্যবহারিক সিদ্ধি ও আয়ত্ত হইয়াছিল। তাঁহার সিদ্ধিলাভের নিদর্শন ক্রমে দেখাইতেছি—তিনি একসময়ে বলিয়াছিলেন, “আমার বংশে সর্পাঘাতে কেহ মরিবে না”। এই বাকসিদ্ধির ফল এখনও এই বংশে আছে বলিয়া শুনা যায়। তাঁহার কৃপায় ইহা চিরসিদ্ধ থাকুক ইহাই প্রার্থনা।
তিনি ধুলিপুরের ধলবেড়া গ্রামের স্ববাস্তু হইতে সমসূত্রপাতে ত্রিশ ক্রোশ পশ্চিমে অবস্থিত এই ভাটপাড়ার গঙ্গায় আধুনিক ভাঙ্গাবাঁধা ঘাটের নিকটে তব্রাহ্মমুহূরর্ত্তে অন্যের লক্ষ্যে প্রত্যহ স্নান করিতে আসিতেন এবং তথায় ভাগীরথীতে সন্ধ্যাতর্পণাদি বর্ণাশ্রমোচিত নিত্যক্রিয়া সমাপন করিয়া সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বেই স্বস্থানে প্রস্থান করিতেন। গুটিকাসিদ্ধির সাহায্যে তাঁহার এই গমনাগমন দুই এক দণ্ড মধ্যেই নিষ্পাদিত হইত।
পথিমধ্যে গোবরডাঙ্গার নিকট ইছাপুর গ্রাম পড়িত, ঐ গ্রামে গোষ্ঠীপতি ব্রহ্মর্ষিকল্প জমীদার রাঘব সিদ্ধান্ত বাস করিতেন। কথিত আছে, এই সিদ্ধান্ত মহাশয়ের সঙ্গে যশোরেশ্বর প্রতাপাদিত্যের খণ্ড যুদ্ধ হয়; যে স্থানে যুদ্ধ ঘটিয়াছিল, ইছাপুরের পূর্ব্বদক্ষিণ কোণে একক্রোশের মধ্যে সেই স্থানটী আজিও প্রতাপপুর নামে অভিহিত আছে; এখন তাহা একটা ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত হইয়াছে। আকাশপথে প্রত্যহ এক তেজঃপুঞ্জের গমনাগমন সিদ্ধান্তমহাশয় লক্ষ্য করিয়া বিস্মিত হইতেন; তিনি তখন প্রাচীন হইলেও কৌতুকী হইয়া স্বীয় তপঃপ্রভাবে সেই তেজঃপুঞ্জরূপী নারায়ণ ঠাকুরকে স্বগৃহে অবতারিত করেন এবং তদীয় রূপ, গুণ, বিদ্যা, ব্রাহ্মণ্য, ও তপঃশক্তির পরিচয় পাইয়া আপনাকে ধন্য বোধ করেন এবং বলেন, ঠাকুর আমি তো যিযাসু, এক্ষণে আমার বংশ পবিত্র করুন। ক্রমে সিদ্ধান্তমহাশয়ের সনির্ব্বন্ধ অনুরোধে ও উচিতপাত্র বুঝিয়া কর্ত্তব্যজ্ঞানে তাঁহার পুত্রাদিকে দীক্ষা দেন, তদবধি ইচ্ছাপুরের চৌধুরী মহোদয়েরা এই বংশের শিষ্য হইয়া আসিতেছেন। এই ঘটনাটী ঠাকুরবংশে এ যাবৎ স্ত্রীপুংসাধারণের নিকট পরম্পরাক্রমে বিবৃত হইয়া আসিতেছে এবং এই পুস্তকসঙ্কলয়িতার ৺পিতামহের শিষ্য ৺সুরনাথ চতুর্ধূরীণ জমীদারপ্রবরের যত্নরক্ষিত পুস্তকরাশির মধ্যে এক তালপত্রে রাঘবসিদ্ধান্তের পুত্রের দীক্ষা লওয়ার প্রসঙ্গ এই রপেই বর্ণিত ছিল বলিয়া তিনি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন।
২য়। মেদিনীপুর পাথরা গ্রামের ৺রামনারায়ণ মজুমদার নারায়ণ ঠাকুরের কাছে দীক্ষা লাইতেছেন এই স্বপ্ন পান, তদবধি বহুবর্ষ বহুস্থানে প্রভুর স্বপ্নদৃষ্ট মূর্ত্তিস্মরণে অনুসন্ধানও করেন, ক্রমে সর্ব্বত্র অকৃতার্থ হইয়া কাশী হইতে নৌযানে প্রত্যাগমনকালে ভাগীরথীতীর অন্বেষণ করিতে-করিতে এই ভাটপাড়ার ঘাটে দর্শন পান, তখন কৃতার্থ হইয়া স্বপ্নবৃত্তান্ত প্রভুর গোচর করেন। প্রভু সমস্ত জ্ঞাত হইয়া বুঝিলেন, তাঁহার প্রতি সত্যই দেবতার অনুগ্রহ, তখন তাহার ঐকান্তিক আন্তরিক প্রেম দেখিয়া ও দেবতার আদেশ মান্য করিয়া এই গঙ্গাতীরেই তাঁহাকে দীক্ষা দেন। তদবধি পাথরা ও জনার্দ্দনপুরের মজুমদার মহাশয়েরা এই বংশের শিষ্য হইয়া আসিতেছেন। বর্ত্তমানে সেই বংশের কিছু উল্লেখযোগ্য মনীষী শ্রীযুক্ত রামদয়াল মজুমদার একজন শাস্ত্রবিশ্বাসী সুপণ্ডিত গুরুপ্রেমিক পাঁচবাড়ীর ৺অমৃতময় ঠাকুরের মন্ত্রশিষ্য ও বংশের অন্যতম প্রধান ভক্ত।
৩য়। ভাটপাড়ার ভাঙ্গাবাঁধাঘাটের সন্নিকটস্থ গঙ্গাতীরবাসী মাধব নামে এক কুম্ভকার প্রত্যহই প্রত্যুষে প্রভুকে স্নানাদিব্যাপৃত দেখিত, কিন্তু সেই তেজঃপুঞ্জকলেবর ব্রহ্মণ্যদেবের নিকট যাইতে বা তাঁহাকে কিছু বলিতে সাহসী হইত না এবং চেষ্টা করিয়াও তিনি কোন পথে কোথা হইতে আসেন বা যান, তাহাও জানিতে পারিত না। এই ব্যাপারটী ক্রমে তাঁহার তদানীন্তন ভূস্বামী পরমানন্দ হালদার মহাশয়ের গোচর করিল। ঐ পরমানন্দ হালদার যশোর জেলার ভুগিরহাটের নিষ্ঠাবান্‌ ভট্টাচার্য্য মহাশয়দের বংশধর; ইনি নবাব সরকারে চাকুরী করিয়া কর্ম্মের পারিতোষিকরূপে বাঙ্গালা ১০০০ সালে ভাটপাড়া তালুক প্রাপ্ত হইয়া গঙ্গাতীরে বাস করেন। এবং তিনি নিজে পবিত্র সদাচারী বিষ্ণুভক্ত ধার্ম্মিক ছিলেন। তিনি কুম্ভকারবাক্যে বিস্মিত হইয়া কোন এক প্রত্যুষে সেই মহাপুরুষের নিকট উপস্থিত হন এবং তাঁহার সম্যক পরিচয় পাইয়া কৃতার্থ হন এবং এখানে বাস করিতে অনুরোধ করেন, কিন্তু প্রভু নিঃসম্পৃক্তের বিশেষতঃ গঙ্গাতীরে প্রতিগ্রহ করিতে বৈমুখ্য দেখাইলে পর হালদারমহাশয় নিজের আজীবন আকাঙ্খিত সিদ্ধপুরুষের নিকট হইতে দীক্ষাগ্রহণের প্রস্তাব করিলেন। নারায়ণঠাকুরও তাঁহাকে যথার্থ পাত্র ও অনুরক্ত বুঝিয়া দীক্ষা দান করেন। হালদার মহাশয়ের অধস্তনদের মুখে শুনিয়াছি “যখন সময় আসে, তখন শুভ সংযোগ সব আপনা-আপনি সংঘটিত হয়” এই কথা তৎকালে পরমানন্দের মুখে বাহির হইয়াছিল, কারণ তাঁহার যেমন সুসময়, তেমনি বসিষ্ঠপ্রতিম গুরু পান। হালদারমহাশয় গুরুর সাময়িক বাসোপযোগী গঙ্গাতীরেই আটচালা করিয়া দেন। স্থায়ী বাস করিবার উপরোধ করিলে প্রভু উত্তর দিয়াছিলেন, স্থায়ী বাস আমার পৌত্র হইতে এখানে ঘটিবে; তাই তাঁহার পৌত্র চন্দ্রশেখর বাচস্পতি হইতেই এখানে স্থির বাস। পূর্ব্বোক্ত এই তিনজনই তাঁহার প্রথম ও প্রধান শিষ্য হন বলিয়া কথিত হয়। কেহ কেহ বলেন, এড়েদার ঘোষাল মহাশয়দিগের পূর্ব্বপুরুষ ভাটপাড়ায় গঙ্গাবাস করিবার কালেই তাঁহার শিষ্য হন। নারায়ণঠাকুরের যে কেবল অধ্যাত্মবিদ্যায় বিশিষ্ট পরিচয় দেখা যায়, তাহা নহে; তাঁহার প্রণীত \textbf{ব্রহ্মসংস্কারমঞ্জরী} একখানি যজুর্বেদীয় মাধ্যন্দিন শাখীদের সংস্কার করিবার উৎকৃষ্ট গ্রন্থ ; সেই মতে আজিও ভাটপাড়ার তদীয় বংশধরেরা সংস্কারকর্ম্ম সাধন করিয়া থাকেন। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখিয়াছেন:—
মুরারিভাষ্যোবটভাষ্যসারসঙ্কেততঃ শাতপথশ্রুতীশ্চ।
বিলোক্য পারস্করগৃহ্যভাষ্যান্যশেষদেশাৎ পরিসঞ্চিতানি ॥
তন্যতে ন্যায়চার্ব্বঙ্গী শ্রীনারায়ণশর্ম্মণা ॥
প্রীতয়ে ধর্ম্মভীরূণাং ব্রহ্মসংস্কারমঞ্জরী ॥
এই গ্রন্থ প্রণয়নকার্য্যে নারায়ণঠাকুর নানা দেশ হইতে যে সকল বেদভাষ্যাদি সংগ্রহ করিয়াছিলেন বলিয়া লিখিয়াছেন, এখন সে সব গ্র্রন্থই দুষ্প্রাপ্য। এই গ্রন্থের বন্দনাশ্লোকে “নমামি শম্ভোশ্চরণারবিন্দং” এই কথা লিখাতে তাঁহাকে শৈব বলিয়া বুঝা যায়, অথচ সিদ্ধিলাভ নিদর্শনে শাক্ত বলাই ঠিক, আবার তাঁহার পূজিত শালগ্রাম শিলা পুরুষপরম্পরায় এই বংশে সেবিত হইয়া আসিতেছেন। ইহাতে এই বুঝায় যে, তিনি “অন্তঃশাক্তো বহিঃ শৈবো সভায়াং বৈষ্ণবো মতঃ’ এই প্রমাণের অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন।
আজি তিনশত বৎসর অতীত হইতে চলিল তিনি জন্মিয়াছিলেন, তাঁহার ব্রহ্মনিষ্ঠার প্রভাবে আজি পর্য্যন্ত এই বংশ বঙ্গে উজ্জ্বল হইয়া আছে এবং হালিসহর, কাঁঠালপাড়া, এড়েদা ও এই ভাটপাড়ায় প্রায় ২০০ দুইশত ঘর তাঁহার বংশধর বাসিষ্ঠসন্তান গৃহস্থালী করিতেছেন। যদিও প্রতি ৫০ বর্ষে অনেক গৃহস্থ নির্ম্মাণ ও দৌহিত্রগতাধিকার হইয়াছেন বলিয়া বংশবৃদ্ধি নাই, তথাপি এখনও এই ভাটপাড়াতেই ১০০ (একশত) ঘর বসিষ্ঠগোত্রীয় আছেন। হালিসহর ও কাঁঠালপাড়ার বসিষ্ঠগোত্রেরা নারায়ণঠাকুরের মধ্যমপুত্র রাঘবরামঠাকুরের ধারায় আসিয়াছেন। আর জ্যেষ্ঠপুত্র শিবচন্দ্র পিতৃদ্বেষে পড়িয়াছিলেন। তাঁহার ধারার দুই-এক ঘর মাত্র ধলচেতা ও রাজপুরে দেখ যায়। ৩য় পুত্র রামনাথের জ্যেষ্ঠপুত্র চন্দ্রশেখরঠাকুরের ধারায় ভাটপাড়ার ঠাকুরেরা এবং ঐ ৩য় পুত্র রামনাথের ২য় পুত্র রামকিশোরের ধারায় এড়েদাবাসী বসিষ্ঠগোত্রীয়েরা। সুতরাং এড়েদাবাসীদের সঙ্গে ভাটপাড়ার-কাঁঠালপাড়া ও হালিসহর অপেক্ষা একপুরুষ নিকট সম্বন্ধ।
ভাটপাড়ায় প্রকৃতবাস নারায়ণঠাকুরের পৌত্র চন্দ্রশেখর বাচস্পতি হইতে ইহা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। ঐ চন্দ্রশেখর হইতে আজি পর্য্যন্ত ২৫০ বর্ষ হইল ইহাতে ৮/৯ পুরুষ হইয়াছে, কোন ধারায় দশপুরুষও দেখা যায়। আমাদিগের বংশে সেইজন্য সাপিণ্ড্যসম্বন্ধ থাকে-থাকে হইয়া দাঁড়াইয়াছে। চন্দ্রশেখরের পত্নী সহমৃতা হন, তাহার পর সহমরণ প্রথা নিবারণ আইন হওয়া পর্য্যন্ত অর্থাৎ এখন হইতে ৯০ বর্ষ পূর্ব্বে দেড়শত ১৫০ বৎসর সময় মধ্যে এই ভাটপাড়ায় নারায়ণঠাকুরের বংশে ৬টী সহমরণ ঘটিয়াছিল। শুনিয়াছি ভাটপাড়ায় শেষসহমরণকারিণীকে নিবৃত্তা করিবার জন্য ফরাসডাঙ্গা হইতে ফরাসী গবর্ণর উপস্থিত হন এবং নানা উপায়ে নিবারণ না পারিয়া আইন বলে এই কার্য্য বন্ধ করিতে ব্রীটিশ গবর্ণমেন্টকে পরামর্শ দেন। শ্রী সময় রাজা রামমোহন রায়ের বিশেষ উদ্যোগে ইহা আইনে পরিণত হয়।
চন্দ্রশেখর বাচস্পতি হইতে আজি পর্য্যন্ত এই ২৫০ বর্ষে বিদ্যা ও ব্রাহ্মণ্যের বিকাশে এই ভাটপাড়ার বসিষ্ঠবংশ অর্দ্ধবঙ্গের ব্রাহ্মণ পরিবারের দীক্ষাগুরু ওশিক্ষাগুরু হইয়া আসিতেছেন। এই বংশে এ যাবৎ কুশাগ্রবুদ্ধি নৈয়ায়িক অধ্যাপক, ধর্ম্মশাস্ত্রাধ্যাপক, তন্ত্রশাস্ত্রপ্রবীণ, জ্যোতিষশাস্ত্রে বিখ্যাত বহুমনীষী হইয়াছেন এবং কাব্য নাটক ও ধর্ম্মসংগ্রাহাদি গ্রন্থের নির্ম্মাতাও অনেক হইয়া গিয়াছেন এবং প্রত্যেকেই সংস্কৃতভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন বলিয়া এই ভাটপাড়া নবদ্বীপের সঙ্গে সমকক্ষতা করিতে পারিয়াছে। এমন সময় গিয়াছে, যে সময় ১০০জন সংস্কৃত ব্যুৎপন্ন বসিষ্ঠসন্তান বাহির হইতেন ও আচার-নিষ্ঠায় আদর্শ ছিলেন। একদিন প্রসিদ্ধ বিদুষী রমাবাই ভাটপাড়াতেই শাস্ত্রপ্রসঙ্গের সদুত্তর পাইয়াছিলেন। ৫০বর্ষ হইতে চলিল, সে দিনও ভূদেববাবুর উদ্দ্যোগে দয়ানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে চুঁচুড়ায় ভাটপাড়ার পাণ্ডিতপ্রবর ৺তারাচরণ তর্করত্নমহাশয়ের যে পৌত্তলিকতা লইয়া বিচার হয়, তখনও তথায় ভাটপাড়া হইতে প্রায় ৭৫ জন সংস্কৃতব্যুৎপন্ন গিয়াছিলেন; বিচারে সভ্যজনেরা ভাটপাড়ার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হন।
এই বংশের সদাচারসম্বন্ধে নিদর্শন দিবার প্রয়োজন নাই; যে সদাচার লক্ষ্য করিয়া বঙ্গের প্রচুর ব্রাহ্মণ-পরিবার শিষ্যতা স্বীকার করিয়াছেন, আজিও এই বংশের প্রবীণারা। পর্য্যন্ত অনেক ব্যবস্থা স্থির করিয়া উপদেশ দিয়া থাকেন।

রামনাথ ঠাকুর

উনি নারায়ণ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র, ইনি ধার্ম্মিক ও সুপণ্ডিত ছিলেন। ১৫৭৫ শাকে ইঁহার স্বহস্তলিখিত চণ্ডীর এখনও দুই-এক খানি পাতা দেখা যায়, মুক্তার ন্যায় লিপি অতি বিশুদ্ধ এবং ১৫৯৩ শাকে ইঁহারই লিখিত অমরকোষ এখনও রহিয়াছে। ইনি অত্যন্ত পিতৃভক্ত ছিলেন, পিতা নারায়ণ ঠাকুরের ভাটপাড়ায় অবস্থান কালে ইনিই অন্যান্য কর্ম্মা হইয়া পিতৃ-পরিচর্য্যায় নিরত থাকিতেন। ইঁহারই এক পুত্রের ধারায় এড়েদাবাসী বসিষ্ঠ গোত্র ঠাকুরেরা।

চন্দ্রশেখর বাচস্পতি

ইনি রামনাথ ঠাকুরের জ্যোষ্ঠপুত্র মিথিলায় থাকিয়া দর্শন ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের সূক্ষ তথ্য সম্যক্‌ অধ্যয়ন করিয়া আসেন এবং অনেক ছাত্রকে কৃতবিদ্য করিয়াছিলেন; ইঁহার ধর্ম্মনিষ্ঠা অত্যন্ত অধিক ছিল। ইনিই ভাটপাড়ার বসিষ্ঠগোত্রীয় গুরুঠাকুরদের আদি-পুরুষ, ইঁহার পত্নী বিমলা দেবী সহমৃতা হন বলিয়া শুনা যায়। এই দম্পতীর পুণ্যপ্রভাবে আজিও তাঁহার বংশধরেরা ভাটপাড়ায় সম্মানের সহিত গৃহস্থালী করিতেছেন। চন্দ্রশেখর বাচস্পতির দুই পুত্র রমাবল্লভ ও বীরেশ্বর। উভয় ধারার বাস্তু যথাক্রমে পুর্ব্ব-পশ্চিমভাগে অবস্থিত হওয়ায় আজি পর্য্যন্ত বীরেশ্বরের বংশধরেরা পশ্চিমবাড়ীর ঠাকুর ও রমাবল্লভের বংশধরেরা পূবের বাড়ীর ঠাকুর বলিয়া আখ্যাত হইয়া আসিতেছেন। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাজপোয়ী এই বংশের বিশেষ সম্মান করিতেন। তাঁহার প্রমাণ অনেক আছে। তিনি সময়ে ইহাদিগকে পরীক্ষা করিয়া অনেক ভূসম্পত্তি দিয়াছিলেন; এ সকল বিষয় পরবর্ত্তী বংশাবলীচরিতে সম্যক্‌ বিবৃত হইয়াছে। তবে একটী কথা বলিয়া রাখি, যখন নারায়ণঠাকুরের আবির্ভাব, তখন বাঙ্গালায় একদিকে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, চণ্ডীদাস ও শ্রীচৈতন্য প্রভৃতি মহাজনেরা কৃষ্ণভক্তিপ্রেমের নির্ঝরিণী বহাইতেছেন, অপর দিকে আগমবাগীশ প্রভৃতি শাক্তসাধকেরা শক্তিসাধনায় দেশকে উদ্বুদ্ধ করিতেছেন। তাঁহাদের তন্ত্রসার প্রভৃতি সাধনাগ্রন্থ রচিত হইতেছে। রঘুনন্দন ভট্টাচার্য্য, গোবিন্দানন্দ কবিকঙ্কণাচার্য্য প্রভৃতি মীমাংসক পণ্ডিতজনেরা স্মৃতিনিবন্ধ প্রণয়ন করিয়া দেশে বর্ণাশ্রম ধর্ম্মের বহুল প্রচার করিতেছেন, বহু গ্রামে সাগ্নিক ব্রাহ্মণ দেখা যাইতেঘছে। এই প্রকারে আর্য্যধর্ম্মের নানারূপে অভ্যুদয়সময়েই সত্যধর্ম্মের অন্তরভ্যুদয়কে সুদৃঢ় করিবার নিমিত্তই অবতারভূত নারায়ণঠাকুরের আবির্ভাব হইয়াছিল। এইবার উদারহৃদয় মদ্ববংশীয় আর্য্যগণ, বন্ধুগণ ও সাধারণ পাঠকগণের নিকট করযোড়ে নিম্নলিখিত আত্মপরিচয় দিয়া এই গ্রন্থের ভূমিকা শেষ করিতেছি।
এ অধম সঙ্কলয়িতা নারায়ণ ঠাকুর হইতে—একাদশ পুরুষ। নারায়ণ ঠাকুর রামনাথ চন্দ্রশেখর রমাবল্লভ বাণেশ্বর রামদুলাল রামচন্দ্র বিশ্বনাথ কৈলাসচন্দ্র নন্দলাল ভৃত্য শ্রীকমলকৃষ্ণ
ভবমহাসাগরতরণে তরণিভূতৌ নারায়ণচরণৌ।
শরণং মম স্তাং সততং যথা শাম্যতু মম চিত্তবিমোহঃ ॥
\begin{flushright} ইতি—নারায়ণম্মৃতি-সমিতি-নিযোজ্য
বিনীত
শ্রীকমলকৃষ্ণ স্মৃতিতীর্থ
সন ১৩৩১, ২০শে মাঘ। \end{flushright} \tikzstyle{box} = [rectangle, rounded corners, minimum width=3cm, minimum height=0.75cm, text centered, draw=black] \tikzstyle{box1} = [rectangle, rounded corners, minimum width=1cm, minimum height=0.50cm, text centered, draw=black] \tikzstyle{arrow} = [thick,->,>=stealth]
\begin{tikzpicture}[node distance=1.5cm] \node (box1) [box1] {বশিষ্ঠ (ঋষির বংশ)}; \node (box2) [box, below of=box1] {পরাশর (ঋষির বংশ)}; \node (box3) [box, below of=box2] {নৈয়ধ্রুব (ঋষির বংশ)}; \node (box4) [box, below of=box3] {মহাবীর (তদ্বংশীয়)}; \node (box5) [box, below of=box4] {কপিল (তৎপুত্র)}; \node (box6) [box, below of=box5] {গদাধর ঠাকুর}; \node (box7) [box, below of=box6] {জনার্দ্দন ঠাকুর}; \node (box8) [box, below of=box7] {নারায়ণ ঠাকুর}; \node (box9) [box, below of=box8] {রামনাথ ঠাকুর}; \node (box10) [box, below of=box9] {চন্দ্রশেখর ঠাকুর}; \node (box11) [box1, below left of=box10] {রমাবল্লভ}; \node (box12) [box1, below right of=box10] {বীরেশ্বর}; \draw [arrow] (box1) -- (box2); \draw [arrow] (box2) -- (box3); \draw [dashed] (box3) -- (box4); \draw [arrow] (box4) -- (box5); \draw [arrow] (box5) -- (box6); \draw [arrow] (box6) -- (box7); \draw [arrow] (box7) -- (box8); \draw [arrow] (box8) -- (box9); \draw [arrow] (box9) -- (box10); \draw [arrow] (box10) -- (box11); \draw [arrow] (box10) -- (box12); \end{tikzpicture}
এই চন্দ্রশেখর ঠাকুরই ভাটপাড়ার বসিষ্ঠ গুরুঠাকুরদের ??? পুরুষ। ইঁহার দুই পুত্র, জ্যেষ্ঠ রমাবল্লভ, দ্বিতীয় বীরেশ্বর। ক্রমানুযাই প্রথম পুত্রের ধরার পরিচয় প্রথমেই দেওয়া গেল।